জমির প্রতি আসক্তিই ব্যাংকের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে

জমির প্রতি আসক্তিই  ব্যাংকের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে

ঋণের জামানত হিসেবে মেশিনারি, ফিক্সড অ্যাসেট ও ফিন্যান্সিয়াল অবলিগেশন্সের মতো আধুনিক ধারণার চর্চা করছে বিদেশী ব্যাংকগুলো। এতে খেলাপি ঋণের নিম্নহার ধরে রেখে ভালো ব্যবসা করছে তারা। যদিও দেশী ব্যাংকগুলো ঋণের জামানত হিসেবে এখনো জমি-বাড়িতেই আটকে আছে। এর সুযোগ নিয়ে সরকারি খাসজমি অথবা মালিকানা নিয়ে বিরোধপূর্ণ জমি জামানত রেখে ঋণ নিচ্ছেন অনেকে। একই জমি একাধিক ঋণের বিপরীতে জামানত রাখার ঘটনাও ঘটছে, যা ব্যাংকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এসব জামানতের বিপরীতে বিতরণ করা ঋণ খেলাপি হয়ে গেলে তা আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকগুলো। জমির দামের পতন ও অতি মূল্যায়নও এতে ভূমিকা রাখছে। ঋণের জামানত হিসেবে ব্যাংকগুলোর জমির প্রতি আসক্তির বিষয়টি উঠে এসেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) গবেষণায়ও। তাতে দেখা গেছে, ২০১৬ সাল শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে মোট জামানতের প্রায় ৬০ শতাংশই ছিল জমি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এ হার ৫০ শতাংশের বেশি হলেও বেসরকারি ব্যাংকে ৬০ শতাংশের উপরে। যদিও বিদেশী ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এ হার ছিল মাত্র ২২ শতাংশ। ‘গ্রাহকের ব্যবসা গোল্লায় যাক, বন্ধকের জমি থাক’ এমন মানসিকতা থেকেই দেশী ব্যাংকগুলো এটা করছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করেন, ঋণের জামানত মানেই জমি। অতীতমুখী এ মনোভাবের কারণে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বাড়ছে। জামানতের মূল্যমানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে অনেক ব্যাংকের ভাগ্য। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি দেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে নয়টি বিদেশী ব্যাংক। বিআইবিএমের গবেষণা অনুযায়ী, গত বছর দেশের ব্যাংকিং খাতের ঋণের স্থিতির বিপরীতে রাখা গ্রাহকদের জামানতের ৫৯ দশমিক ২৭ শতাংশই ছিল স্থাবর সম্পত্তি বিশেষ করে জমির। এ সময় রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এ হার ছিল ৫৩ দশমিক ৪১ ও বিশেষায়িত দুটি ব্যাংকের ৪০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ঋণের বিপরীতে জমিকে জামানত হিসেবে রাখার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়েও এগিয়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। গত বছর শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট জামানতের ৬৩ দশমিক ৬৬ শতাংশই ছিল জমি। ঋণের জামানত হিসেবে জমি যে উত্তম ব্যবস্থা নয়, তা স্বীকার করছেন ব্যাংকাররাও। ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বণিক বার্তাকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তাদের হাতেই দেশের বেসরকারি ব্যাংকের গোড়াপত্তন হয়েছে। ফলে বেসরকারি হলেও ব্যাংকগুলোর ব্যবসার ধরন ও কার্যক্রম পুরনো ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ঋণের জামানত হিসেবে স্থাবর সম্পত্তি কখনই উত্তম ব্যবস্থা নয়। কারণ জমির দাম কমে গেলে ব্যাংকের সম্পদের মানও কমে যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। আট-দশ বছর আগে দেশে জমির দাম অস্বাভাবিক বেড়েছিল। এখন সে বাস্তবতা নেই, বরং কমেছে জমির দাম। আবাসন ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে বারিধারায় কাঠাপ্রতি জমির দাম ছিল ৫০ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে সে জমির দাম বেড়ে ৬ কোটি টাকা দাঁড়ায়। আর এখন বিক্রি হচ্ছে ৫ কোটি টাকায়। গুলশানেও ২০১৩ সালে কাঠাপ্রতি জমির দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৫ কোটি টাকা। এখন সে দাম নেমে এসেছে ৪ কোটি টাকায়। বনানী এলাকায় ২০১৩ সালে সাড়ে ৩ কোটি টাকায় বিক্রি হওয়া প্রতি কাঠা জমির দাম চাওয়া হচ্ছে ৩ কোটি টাকা। একইভাবে রাজধানীর অন্যসব অভিজাত এলাকার পাশাপাশি সারা দেশেই জমির দাম কমেছে। সেই সময় উচ্চমূল্যের এসব জমির বিপরীতে দেয়া ঋণ দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে ব্যাংকিং খাতে। তারপরও প্রথাগত ব্যাংকিংয়ের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণের জামানত হিসেবে অতিরিক্ত জমিনির্ভর বলে জানান অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামস-উল-ইসলাম। তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এখনো আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি। বিদেশী ভালো ব্যাংকগুলো জমি জামানত রেখে কোনো ঋণ দেয় না। তারা দেখে কোম্পানির নগদপ্রবাহ, ভবিষ্যৎ ও করপোরেট গ্যারান্টি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নেয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই জমির মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয়। ফলে ঋণ নেয়ার আগেই গ্রাহক প্রতারণায় জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে ওই ঋণ খেলাপি হয়ে যায়। জামানত হিসেবে জমি থেকে আমাদের সরে আসা দরকার। ঋণের জামানত হিসেবে মেশিনারি, করপোরেট গ্যারান্টি ও ফিন্যান্সিয়াল অবলিগেশন্স অনেক বেশি নিরাপদ হলেও দেশের ব্যাংকিং খাতের সেদিকে মনোযোগ কম। বিআইবিএমের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকিং খাতের জামানতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ হলো ব্যাংক গ্যারান্টি। ২০১৫ সাল শেষে জামানত হিসেবে গ্যারান্টি ছিল ১৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এছাড়া জামানতের ৫ শতাংশ মেশিনারি ও ফিক্সড অ্যাসেট এবং ফিন্যান্সিয়াল অবলিগেশন্স ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। পুরো ব্যাংকিং খাতে ঋণের জামানত হিসেবে মেশিনারি ও ফিক্সড অ্যাসেট ৫ শতাংশ হলেও বিদেশী ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা ১৮ দশমিক ৩১ শতাংশ। যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে মেশিনারি ও ফিক্সড অ্যাসেট রয়েছে ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এ হার মাত্র ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। এছাড়া বিদেশী ব্যাংকের ঋণের জামানত হিসেবে ফিন্যান্সিয়াল অবলিগেশন্স রয়েছে ২৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এ হার ৩ দশমিক ৩৪ ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। জামানত হিসেবে মেশিনারি ও ফিক্সড অ্যাসেট এবং ফিন্যান্সিয়াল অবলিগেশন্স অনেক বেশি নিরাপদ উল্লেখ করে বেসরকারি ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরী বলেন, জমির বিপরীতে ঋণ দেয়ার সময় ব্যাংকগুলো অনেক ক্ষেত্রেই জামানতের যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে না। এ কারণে জামানতের মূল্যমানের চেয়েও অনেক সময় বেশি ঋণ দেয়া হয়। পরবর্তীতে ওই ঋণ খেলাপি হয়ে গেলে দেখা যায় জামানতের ওই জমি বিতর্কিত। সরকারি খাসজমি বা একাধিক মালিকানায় থাকা জমিও ব্যাংকগুলো জামানত রেখে ঋণ দিয়ে দেয়। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য জামানতের সম্পদ নিলামে তোলার পর দেখা যায়, মূল্যমানের অর্ধেক দামেও বিক্রি হচ্ছে না। তাই ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যবসার নগদপ্রবাহ বা প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ দেখা দরকার। জামানত হিসেবে জমিকে বেশি গুরুত্ব দেয়ার কারণে একই সম্পত্তি একাধিক ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে ঋণ নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামের এক গ্রাহকের ক্ষেত্রে একই জমি চার ব্যাংকের কাছে জামানত রেখে ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। ঋণের অর্থ আদায়ে মামলায় জড়িয়েছে ওই চার ব্যাংকই।
উত্তর কোরিয়া কেন্দ্রিক উত্তেজনা এশিয়ার প্রবৃদ্ধির জন্য হুমকি : বিশ্বব্যাংক পূর্ববর্তী

উত্তর কোরিয়া কেন্দ্রিক উত্তেজনা এশিয়ার প্রবৃদ্ধির জন্য হুমকি : বিশ্বব্যাংক

বাংলাদেশ বিশ্বের ৪র্থ চাল উৎপাদনকারী দেশ, উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণ পরবর্তী

বাংলাদেশ বিশ্বের ৪র্থ চাল উৎপাদনকারী দেশ, উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণ

কমেন্ট