অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ৩৪৩ অ্যাকাউন্টে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা জব্দ
অন্তর্বর্তী সরকার দেশের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিন শতাধিক সাবেক মন্ত্রী-এমপি, গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। সন্দেহজনক লেনদেন ও বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগে প্রতিদিনই শতাধিক ব্যাংক হিসাব জব্দ করছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তবে ৫ আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিএফআইইউ, এনবিআর এবং দুদক যৌথ প্রচেষ্টায় ৩৪৩ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে। তাদের অ্যাকাউন্টে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে।
বিএফআইইউ সূত্রে জানা যায়, এরই মধ্যে ২২৫টি তদন্ত রিপোর্ট সিআইডি এবং দুদকে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ২০টির অডিট রিপোর্ট সম্পন্ন হয়েছে। অভিযুক্তদের সবাই বিগত সরকারের আমলে অবৈধ সুবিধা নেওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। খুব শিগগিরই বাকিগুলোর অডিট সম্পন্ন করে দুদক ও সিআইডিতে পাঠানো হবে বলে নিশ্চিত করেছেন বিএফআইইউর একজন কর্মকর্তা।
সূত্র আরো জানায়, আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা জোট এগমন্টের সঙ্গে যুক্ত ১৭৭টি দেশ ছাড়াও একাধিক দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি রয়েছে বিএফআইইউর। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া সম্ভব্য সব দেশে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক সহায়তায় পাচার হওয়া অর্থ ফেরতে সব রকম প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার।
সম্প্রতি এক সেমিনারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশ থেকে প্রতিবছর ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে।
এর অন্যতম মাধ্যম ছিল বাণিজ্য। পাচার হওয়া এসব অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। তবে তা সময়সাপেক্ষ। অর্থপাচার বন্ধে রাজনীতি, আমলাতন্ত্র ও ব্যবসাকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আন্ত সংস্থা টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করেছে সরকার। এই টাস্কফোর্সের সভাপতি করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে। আর টাস্কফোর্সকে সাচিবিক সহায়তা দেবে বিএফআইইউ।
পাচারের টাকা ফেরাতে প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠকের সময় পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সহায়তা চেয়েছেন তারা। এ ছাড়া বিএফআইইউ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থসম্পদ সম্পর্কে জানতে বিভিন্ন দেশে চিঠি দেওয়া শুরু করেছে। সিআইডি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), কাস্টমস, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিএসইসি ও দুদক অর্থপাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করেছে তাদের সম্পদ দেশে ফেরত আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত। যেহেতু আমাদের দেশ থেকে পাচারের টাকা ফেরত নিয়ে যাওয়ার উদাহরণ আছে, সুতরাং আমরা পরব না কেন? এগমন্টের দেশসমূহ, যাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি আছে, নতুন চুক্তি সম্পাদন করে এবং ইন্টারপোলের সাহায্যে এসব সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।’
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি ও ইভিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটা বেশির ভাগ ব্যবসায়ীদের জন্য ভালো খবর। কারণ ৯৮ শতাংশ ব্যবসায়ী অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত নন। দেশের সম্পদ দেশে ফিরে এলে স্বস্তি ফিরে আসবে। ব্যাংক খাতের সমস্যারও সমাধান হবে।’
বিএফআইইউয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ‘অর্থপাচার রোধ ও পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আপসহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রথমত, পাচারের সঠিক তথ্য উদ্ধার, পরিমাণ নির্ণয় ও পরে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দিকে আগানো হবে। এ ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
কমেন্ট