অবশেষে ভারতীয় গণমাধ্যমও জানাল, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের সেই ভিডিওটি ভুয়া
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ভুয়া তথ্য ছড়ানোয় শীর্ষস্থানে রয়েছে ভারত। ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সংবাদমাধ্যমগুলোও বিভিন্ন অপপ্রচার ও ভুয়া তথ্যে সয়লাব হয়ে গেছে। মাইক্রোসফটের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। মাইক্রোসফটের জরিপ অনুযায়ী, ৬০ শতাংশেরও বেশি অনলাইনে ভুয়া খবরের মুখোমুখি হয়েছেন ভারতীয়রা; যেখানে এ হারের বৈশ্বিক গড় ৫৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ নিয়েও দেশটির মূলধারার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম যাচাই-বাছাই না করেই বিভিন্ন ভুল খবর প্রকাশ করছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও সারা দেশে সংঘর্ষ, হত্যাকাণ্ড, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ভারতেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশ ইস্যুতে ছড়ানো হচ্ছে একের পর এক গুজব।
রাষ্ট্র ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর গত ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত অন্তত ১৩টি ভুয়া খবর পেয়েছে ফ্যাক্ট চেক বা তথ্য যাচাই সংস্থা রিউমার স্ক্যানার।
এমন ভুয়া খবর প্রচারের তালিকায় ভারতের অন্তত ৪৯টি গণমাধ্যমের নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে রিপাবলিক বাংলা, হিন্দুস্তান টাইমস, জি নিউজ, লাইভ মিন্ট, ইন্ডিয়া টুডে, এবিপি আনন্দ এবং আজতক অনবরত গুজব প্রচার করে যাচ্ছে।
কেন ভারতের মিডিয়া বাংলাদেশ নিয়ে ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে- এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি।
গণমাধ্যমের একাধিক বিশ্লেষক বলছেন, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকেই বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের গণমাধ্যমে একটা বিরোধিতার সুর দেখা যাচ্ছিল। তবে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারির পরে তা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক ভাষণ, কাগজ-টিভির প্রতিবেদন এবং সামাজিক মাধ্যম– সব মিলিয়ে যে আখ্যান তৈরি করা হচ্ছে ভারতে, তা দেশটির হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অনেক সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করে ফেলছেন।
কী কী ভুয়া খবর
ভারতের তথ্য যাচাই ও ভুয়া খবরের খোঁজ দেয় এরকম একটি ওয়েবসাইট ‘অল্ট নিউজ’ গত কয়েকদিনে বাংলাদেশ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি খবর খুঁজে পেয়েছে, যেগুলিতে ‘বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপরে আক্রমণ’ হচ্ছে বলে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়েছে।
এইসব ভুয়া টুইট বা ফেসবুক পোস্টগুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে ‘সেভ বাংলাদেশি হিন্দুজ’ বা ‘অল আইজ অন বাংলাদেশি হিন্দুজ’ অথবা ‘প্রে ফর বাংলাদেশি হিন্দুজ’। আরও একটি বাক্য এধরনের ভুয়া পোস্টগুলিতে দেখা গেছে, যার মোটামুটি বাংলা অনুবাদ হল ‘জিহাদিরা বাংলাদেশের হিন্দুদের কেটে ফেলছে অথচ বিশ্ব একেবারে চুপ করে আছে’।
অল্ট নিউজের সম্পাদক প্রতীক সিনহা বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলা হচ্ছে এটাও যেমন ঘটনা, তেমনই এটাও সত্য যে বহু ভুয়া খবর, অসত্য তথ্য সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা হচ্ছে মূলত দক্ষিণপন্থি সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। এর মধ্যে অনেক ভুয়া তথ্যই আবার মূলধারার গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে – এটা আমরা দেখতে পাচ্ছি।’
অল্ট নিউজ যেমন একটি ভুয়া খবর তুলে ধরেছে যেখানে প্রায় দুই মিনিটের একটি ভিডিওতে দেখা গেছে যে একদল টুপি পড়া মানুষ লাঠি আর লোহার রড হাতে একটা চাষের ক্ষেতের ওপর দিয়ে উত্তেজিত ভাবে চলে যাচ্ছেন। পিছনে গুলির শব্দ শোনা গেছে।এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লেখা হয়েছে, ‘কট্টরপন্থি জনতা বাংলাদেশের শেরপুর জেলার মুর্শিদপুরের একটি গ্রামে হামলা চালিয়েছে। হিন্দুদের বাড়ি, ক্ষেতের ফসল ধ্বংস করে দিয়েছে। একজনকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি একটি সুফি মাজার ভাঙচুর করে লুঠ করে হয়েছে।’
অল্ট নিউজ বলছে এই টুইটটি তিন লাখ ৬৬ হাজার মানুষ দেখেছেন আর সাড়ে ছয় হাজার রিটুইট করা হয়েছে।
অল্ট নিউজ বলছে কয়েকটি শব্দ দিয়ে সার্চ করেই তারা বার করে ফেলতে পেরেছে যে ভিডিওটি ২৬ নভেম্বর শেরপুরের মুর্শিদপুরে দরবার শরিফে যে হামলা হয়েছিল, সেই ঘটনার ভিডিও। বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদপত্রে ওই ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ২৭ নভেম্বর। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরে হামলার কোনও ঘটনাই নয় এটি।
ওই ওয়েবসাইটটি ২৯ নভেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের একটি ভিডিও কীভাবে হিন্দুত্ববাদী সামাজিক মাধ্যমগুলো ‘হিন্দুদের গণহত্যা’ বলে ছড়িয়ে দিয়েছে।
ওই ভিডিওর ডেস্ক্রিপশনে লেখা হয়েছে, ‘বাংলাদেশি হিন্দুদের গণহত্যা ভারত এবং সারা বিশ্বের হিন্দুদের চোখ খুলে দিয়েছে। আপনার বাংলাদেশের ভাই বোনেদের পরিত্যাগ করবেন না – তারা হাসিনার পতনের পর থেকেই ইসলামিদের রাগের শিকার হচ্ছেন।’
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী কয়েকটি ভিডিও একসঙ্গে জুড়ে একটি পোস্ট করেছিলেন, যার মধ্যে অল্ট নিউজ দেখতে পেয়েছে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ওই প্রথম ভিডিওটিও। এই টুইটের ডেস্ক্রিপশনে তিনি লিখেছিলেন যে কীভাবে সনাতনী হিন্দুদের ওপরে আক্রমণ হচ্ছে। তিনি অবশ্য ‘জিনোসাইড’ বা গণহত্যা যে এই ঘটনাগুলিকে এখনও বলা যায় না, সেটাও লিখেছিলেন।
অল্ট নিউজ খুঁজে পেয়েছে যে আসলে ভিডিওটি বাংলাদেশের বিডিনিউজ২৪.কম – এর এবং ঘটনাটি ছিল ২৫ নভেম্বরের, যেদিন ঢাকার মাতুয়াইলের মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ আর কবি নজরুল সরকারি কলেজের ছাত্ররা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে মোল্লা কলেজের ছাত্র অভিজিৎ হাওলাদারের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে।
এর সঙ্গে কোনও ‘হিন্দুদের গণহত্যার’ যোগই নেই। তবুও লাখ লাখ মানুষ ওইসব ভিডিওগুলি দেখেছেন, রিটুইট করেছেন – যার ফলে একটা জনমত তৈরি হতে শুরু করে দেয়।
আবার এরকমও ভিডিও দেখা গেছে, যেখানে একটি অগ্নিকাণ্ড দেখানো হয়েছে। বলা হচ্ছে চট্টগ্রামের একটি হিন্দু বসতিতে আগুন দেওয়ার কথা। ভিডিওর ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রথম কয়েক সেকেন্ড সম্ভবত ‘হিন্দি’তে কথা বলা হচ্ছে এবং তার পরের অংশটিতে খুবই শান্ত স্বরে বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে অগ্নিকাণ্ডের। ওই একই ভিডিও অন্তত দুটি ভিন্ন ভয়েস ওভার সহ যে শেয়ার করা হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে, তা বিবিসি বাংলা দেখেছে।
ভিডিওটি শেয়ার হওয়ার পরে সেটি অন্তত একটি বাংলা টিভি চ্যানেল দীর্ঘক্ষণ ধরে তা দেখিয়েছে।
তথ্য যাচাই না করেই প্রকাশ?
একটি সর্বভারতীয় টিভি নিউজ নেটওয়ার্কের পূর্বাঞ্চলীয় সম্পাদক বিশ্ব মজুমদারও বিষয়টি স্বীকার করলেন।
এখানে জানিয়ে দেওয়া দরকার, তার অধীনস্থ কোনও চ্যানেল ওপরে উল্লেখিত ‘হিন্দু বসতিতে আগুন’এর ভিডিওটি দেখায়নি। সেটা অন্য একটি চ্যানেলের ঘটনা।
‘নেটওয়ার্ক ১৮’-এর পূর্বাঞ্চলীয় সম্পাদক মজুমদার বলছিলেন, ‘কোনও তথ্য বা ভিডিও পেলে সেটা যাচাই বাছাইয়ের ব্যাপারটাই এখন উঠে গেছে। আমরা যে সাংবাদিকতার শিক্ষা পেয়েছি, ২৫-৩০ বছর ধরে কাজ করছি, তাদের সঙ্গে এখনকার সাংবাদিকদের কাজের ধরনটাই বদলে গেছে। এরা যে কোনও ঘটনা ঘটলে সেটা যাচাই না করেই অন্য চ্যানেলে দেখতে পেলেই তা চালিয়ে দেয়। ব্রেকিং নিউজের প্রতিযোগিতা চলছে এটা! কে কত আগে সেনসেশন তৈরি করতে পারবে, সেই লড়াই চলছে চ্যানেলগুলোর মধ্যে।
‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে যা সংবাদমাধ্যমে দেখানো হচ্ছে, তা সত্যিই সাংবাদিকতা নয়,’ বলছিলেন মজুমদার।
বিভিন্ন ভারতীয় টিভি চ্যানেলে উঁচু গলায়, চিৎকার করে কথা বলে বাংলাদেশ সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলি পরিবেশন করা হচ্ছে, যেন একটা যুদ্ধ বেঁধেছে বাংলাদেশের সঙ্গে! সেই ‘যুদ্ধে’ একদিকে বাংলাদেশের হিন্দুরা, অন্যদিকে মুসলমানরা – এমনভাবেই পরিবেশন করা হচ্ছে খবর।
অল্ট নিউজের সম্পাদক প্রতীক সিনহা বলছিলেন, ‘ভুয়া তথ্য পরিবেশন যে শুধুমাত্র বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে হচ্ছে তা নয়। ভারতের বাইরের নানা ঘটনায় – যেমন ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও এরকম ভুয়া তথ্য পরিবেশনের ঘটনা আমরা দেখেছি।’
কমেন্ট